ঢাকার দোহার ও নবাবগঞ্জে এখন আলোচনার মধ্যবিন্দু দোহার উপজেলার পূর্ব লটাখোলা এলাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী তপন কর্মকার হত্যা। সর্বস্তরের মানুষের প্রশ্ন কেন, কিসের জন্য তপনকে এমন নির্মমভাবে বাড়িতে ঢুকে হত্যা করা হলো? কারা জড়িত এমন নৃশংস হত্যার সাথে? এমন আলোচনা হত্যার পর থেকেই সকলের মনে উঁকি দিচ্ছিল। তবে পুলিশ মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে হত্যার রহস্য। এরই মধ্যে মূল পরিকল্পনাকারীসহ ৬ আসামীকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বুধবার (২২ জুলাই) দুপুরে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও পরিকল্পনা নিয়ে প্রেস বিফ্রিং করেছে। কিভাবে, কেন, কারা এমন হত্যাকান্ডের জড়িত পুলিশের তদন্তে উঠে এসে সকলের নাম। এ ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত আসামীদের মধ্যে সাধু বিশ্বাস আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
ঘটনার পরিকল্পনাঃ তপনের বড়ভাইয়ের স্ত্রী মনি হালদার তার বোনের জামাই ভোলানাথ হালদারকে জানান তপনের সিন্ধুকে আনুমানিক দুই কেজি স্বর্ণ আছে। এ ঘটনা জানার পর গত একমাস ধরেই মনি ও তার বোনজামাই ভোলানাথ স্বর্ণগুলো ডাকাতির পরিকল্পনা করেন। ডাকাতির কাজে সহযোগিতার জন্য তারা নিজেদের কাছের লোকজনের সাথে আলোচনা করেন। ডাকাতি সফল হলে প্রত্যেককে ৩ লাখ করে টাকা দেওয়া হবে পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা উপজেলা জয়পাড়া বাজারের একটি কামারের দোকান থেকে দুইটি বড় দা, একটি চাপাতি ও দুইটি আরএফএলের ছুরি কিনেন।
যা ঘটেছিল ওই রাতে: ঘটনার দিন (১৪ জুলাই) মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে তপনের বৌদি মনি হালদারের সহায়তায় আসামীরা বাড়িতে প্রবেশ করে তারই ঘরের বারান্দায় বসে রাত গভীর হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকেন। তাদের সকলের মুখ কালো কাপড়ে বাঁধা ছিল। একপর্যায়ে বাড়ির ভিতর মোবাইল ফোনে কথা বলার আওয়াজ পেয়ে মনি হালদারের স্বামী কৃষ্ণ কর্মকার দেখেন বাড়িতে অপরিচিত লোকজন। তখন তিনি চিৎকার করতে থাকে। বড় ভাইয়ের চিৎকার শুনে তপন কর্মকার ঘর থেকে বের হয়ে আলী নামের একজনকে জড়িয়ে ধরে চোর চোর বলে চিৎকার করে। তখন আলী তপনকে চিৎকার দিতে নিষেধ করে। কিন্ত তপন চিৎকার করতে থাকলে আসামী আলী তার হাতে থাকা চাকু দিয়ে তপনের পেটে এবং আরেক আসামী আব্দুল হাই দা দিয়ে তপনের ঘাড়ে আঘাত করে। এসময় ডাকাতি না করেই আসামীরা সবাই ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে যায়। তখন নিজের অপরাধ ঢাকতে অপহরনের নাটক সহ নানা কৌশলের আশ্রয় নেন নিহতের ভাবি মনি হালদার। নিজেই বাড়ির পাশের ময়লা পুকুর পাড়ে ঝোপের আড়ালে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকার ভান করে থাকে। সকালে তাকে উদ্ধার করে এলাকাবাসী। পরদিন বুধবার দুপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় তপন কর্মকার।
যেভাবে হত্যার রহস্য উদঘাটন: এ ঘটনায় নিহত তপনের বড় ভাই কৃষ্ণ কর্মকার (১৬ জুলাই) অজ্ঞাতনামা ৫/৬ জনের বিরুদ্ধে দোহার থানায় মামলা করেন। মামলা নং- ১১, ধারা- ৩০২/৩৪ পেনাল কোড তৎসহ নারী ও শিশু নির্যাতন আইন সংশোধনী ২০০৩ এর ৭ ধারায় মামলা রুজু হয়। ঘটনার রহস্য উদঘাটনে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন সরদারের দিক নির্দেশনায় ঢাকা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ দক্ষিণ) মো. হুমায়ুন কবীর, দোহার সার্কেলের এএসপি জহিরুল ইসলাম, দোহার থানার ওসি তদন্ত আরাফাত হোসেন, জেলা গোয়েন্দা শাখা উত্তর, জেলা গোয়েন্দা শাখা দক্ষিন যৌথভাবে কাজ শুরু করেন। দক্ষ অফিসারদের নিয়ে গঠিত তদন্ত টিম দ্রুত আসামীদের গ্রেপ্তার ও হত্যার রহস্য উদঘাটনে সফল হয়। ঘটনার পরিকল্পনাকারী তপনের বড় ভাইয়ের স্ত্রী মনি হালদার (৩৫) পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, নিহত তপনের বৌদি মনি কর্মকারের বোন জামাই ভোলানাথ ওরফে হৃদয় (৪৬), প্রেমানন্দ হালদার (৩০), সাধু বিশ্বাস (৩৫), সবুজ হালদার (৩০), আলী মিয়া (৩২) ও আব্দুল হাই (৩৮)। এর মধ্যে ভোলানাথ নবাবগঞ্জ উপজেলার হাসনাবাদ গ্রামের অমূল্য হালদারের ও প্রেমানন্দ একই গ্রামের নিতাই হালদারের ছেলে। সম্পর্কে তাঁরা মামা-ভাগিনা। এছাড়া সাধু বিশ্বাস দোহার উপজেলা অরঙ্গাবাদ গ্রামে সন্তোষ বিশ্বাসের ছেলে, সবুজ হালদার নবাবগঞ্জ উপজেলার কান্দাবাড়িল্যা গ্রামের সুরেশ হালদারের ছেলে এবং আলী মিয়া ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় বৈইল্লাহাটির দবির শেখের ছেলে। সবশেষ আব্দুল হাই নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
উল্লেখ্য যে, গত ১৪ জুলাই মঙ্গলবার রাত পৌনে ১২টার দিকে উপজেলার পূর্ব লটাখোলা এলাকায় স্বর্ণ ব্যবসায়ী তপন কর্মকার’কে কুপিয়ে আহত করে দুর্বৃত্তরা। পরের দিন বুধবার দুুপুর ১২টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই স্বর্ণ ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন